সন্দ্বীপ ভ্রমণ ও পরিচয় | Sandwip travel and identity

সন্দ্বীপ বাংলাদেশের সবছেয়ে পুরাতন দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। যা বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বকোণে ২২°১৬´ থেকে ২২°৪৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৭´ থেকে ৯১°৩৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত।


সন্দ্বীপ উপজেলার মানচিত্র


সন্দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে সন্দ্বীপ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। সন্দ্বীপে ১৯৯৯ সালে একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ সন্দ্বীপ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম সন্দ্বীপ থানার আওতায় পরিচালিত হয়।


পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইল ছিল। কিন্তু মেঘনার রাক্ষুসি ডেউয়ের ছোবলে ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সন্দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার) ও প্রস্থ ৩-৯ মাইল (৫-১৫ কিলোমিটার)।

চট্টগ্রাম উপকূল ও সন্দ্বীপের মাঝখানে সন্দ্বীপ চ্যানেল অবস্থিত। চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে নদীপথ ও স্থলপথ মিলিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে এ উপজেলার অবস্থান। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। সন্দ্বীপের প্রায় ২০ মাইল পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপের অবস্থান। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা ও মীরসরাই উপজেলা, উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তারও পশ্চিমে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর

ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান ছিল। সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে বার আউলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিষ্কার করেন এবং নামকরণ করেন "শুণ্যদ্বীপ", যা পরবর্তীতে "সন্দ্বীপে" রুপ নেয়। ইতিহাসবেত্তা বেভারিজের মতে চন্দ্র দেবতা "সোম" এর নামানুসারে এই এলাকার নাম "সোম দ্বীপ" হয়েছিল যা পরবর্তীতে "সন্দ্বীপে" রুপ নেয়।কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে "স্বর্ণদ্বীপ" আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত "স্বর্ণদ্বীপ" হতে "সন্দ্বীপ" নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দূর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় "স্যান্ড-হীপ" (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান `সন্দ্বীপ` নামের উৎপত্তি হয়।


সন্দ্বীপের লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবীখ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন এবং সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথিবীখ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানি করা হতো। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন।ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। লবণ ও জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন।
এছাড়া ভ্রমণ ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসি ও ওলোন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন।এই দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী মোজাফ্‌ফর আহমেদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপ ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তাঁর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জনপদ সন্দ্বীপ অনেকদিন অবহেলিত থাকলেও ১৯৯১ সালের পর থেকে মাহফুজুর রহমান মিতা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের এমপি ওনার হাত ধরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটতে থাকে। যার ফলে সন্দ্বীপ এখন আর অবহেলিত জনপদ নয়।

প্রাকৃতিক সুন্দরে ঘেরা সন্দ্বীপ চাইলেই আপনারা ভ্রমন করে আসতে পারেন। তবে বর্ষাকাল অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, তখন সন্দ্বীপ চ্যানেল তখন খুবই উত্তাল থাকে। যেহেতু একমাত্র নদীপথেই আপনাকে সন্দ্বীপ পোঁছাতে হবে।
সন্দ্বীপের সূর্যাস্তের চিত্র

যেভাবে যাবেনঃ


সন্দ্বীপ যেতে সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রামগামী যেকোন দূরপাল্লার বাস কিংবা নগরীর  অলংকার বা এ. কে. খান মোর থেকে লোকাল মেক্সিতে সীতাকুণ্ডগামী যানবাহনে করে যেতে হবে। নামতে হবে কুমিরা। আপনার বাসকে কুমিরা স্টিমার ঘাট যাবার স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিতে বলুন। সেখান থেকে অটো বা রিক্সায় করে যেতে হবে কুমিরা স্টিমার ঘাটে। ভাড়া নিবে জনপ্রতি ১০ টাকা। এখান থেকে যেতে হবে জলপথে সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট। মূল ভূখণ্ড থেকে সন্দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র পথ এই জলপথ।
কুমিরা স্টিমার ঘাট
ছবিঃ মঈন উদ্দিন
কুমিরা স্টিমার ঘাট থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটের যাওয়ার দ্রুততম উপায় স্পিড বোট। যেতে সময় লাগে আধা ঘণ্টার মত, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৫০ টাকা। স্পিড বোটের জন্য আপনাকে প্রথমে লাইন ধরে সিরিয়াল নিতে হবে। এরপর মূল ঘাটে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আপনার সিরিয়াল অনুযায়ী স্পিড বোটে উঠার জন্য। এছাড়াও সময়ে সময়ে ট্রলার ছেড়ে যায় কুমিরা স্টিমার ঘাট থেকে, যাতে যেতে ১ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
থাকার ব্যবস্থাঃ
অবশ্যই থাকার হোটেল আছে তবে বিশাল বহুল কিছু না। রাতের মাথা গোজার ঠাই এর মতো। খরচ ও খুবই কম। এনাম নাহার মোড়ে থাকার কয়েকটি হোটেল আছে সেখান থাকতে পারেন। এছাড়া সেনেরহাট এলাকায় ভালো একটি হোটেল আছে সেখানে থাকতে পারেন।  উপজেলা পরিষদ থেকে অনুমতি নিয়ে সরকারি ডাক বাংলোতে থাকতে পারেন।
সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূল



তাছাড়া সন্দ্বীপের পশ্চিম পাড়ে ক্যাম্পিং করে আপনার ভ্রমণ  আরও উপভোগ্য করতে পারেন।

Comments